চীনের বিশ্বনেতা হয়ে ওঠার এই কি মোক্ষম সময়?

0
257

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেইজিংয়ের ঐতিহাসিক ফোরবিডেন সিটি বা নিষিদ্ধ নগরে ২০১৭ সালে স্বাগত জানানোর সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাজবাড়ির তিনটি হলের নাম উল্লেখ করছিলেন। ট্রাম্পকে তিনি বলছিলেন, স্থানীয় চীনা ভাষায় দেওয়া ওই তিনটি নামেরই অর্থ হলো ‘শান্তি’। তিনি ট্রাম্পকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, কনফুসিয়াসের দর্শনের মূল কথা হলো ‘সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো শান্তি’।

বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় এই বাণী এখন বিশ্বের জন্য সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই চরম দুঃসময়েও বিশ্বের এই দুই ক্ষমতাধর শক্তির মধ্যে বৈরী ভাব রয়েছে। একদিকে আমেরিকান সমাজে চীন-বিরোধিতা মাথাচাড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে, চীনে এখন এই কথা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, ‘আমেরিকার ওপর তোমার রাগ না হলে বুঝতে হবে, তুমি দেশপ্রেমিক নও।’

কোভিড-১৯ সংকট এই দুটি দেশের সামনেই গালাগালি বাদ দিয়ে গলাগলি করার একটা মহান সুযোগ এনে দিয়েছে। বিশেষ করে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে চীনকে তার কৌশলগত সুবিধা-অসুবিধার কথা বিশ্ববাসীকে বলা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর আস্থা অর্জনের বিষয়ে একটি বড় সুযোগ তার সামনে এসেছে।

বিশ্ব এখন একসঙ্গে তিনটি সংকটে পড়েছে। সেগুলো হলো: স্বাস্থ্যসংকট, অর্থনৈতিক সংকট এবং তারল্যসংকট। এর ফলে বহু দেশের অর্থনীতি ২০০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দা নয় বরং ১৯৩০ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মহা আর্থিক ধসের চেয়েও খারাপ অবস্থার মুখে পড়েছে।

গ্রেট ডিপ্রেশনের অভিজ্ঞতা আমাদের যে শিক্ষা দেয় তা হলো, এই ধরনের সংকট দেখা দিলে ধনী দেশগুলো সংরক্ষণবাদের দিকে ঝুঁকে যায়। যেমন গ্রেট ডিপ্রেশনের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে এ–সংক্রান্ত আইন পাস করেছিল। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বার্থ ঠিক রাখতে গিয়ে অন্যদের স্বার্থ খর্ব করেছিল। এখন এই সংকটের সময় ধনী দেশগুলো যদি ‘শুধু নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে’ ডুবে থাকে এবং যে দেশগুলোকে তারা নেতৃত্ব দেয়, সে দেশগুলোকে সহায়তা না করে তাহলে তারা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য ধনী দেশগুলোর এখন অন্যদের সহায়তা করার অবস্থা নেই। কিন্তু চীনের সেই সক্ষমতা আছে। এই সুযোগটি চীন সহজেই নিতে পারে। গত ২০ বছরে যত বড় বড় বৈশ্বিক সংকট এসেছে, তার সবগুলোই অন্য দেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরালো করার সুযোগ বাড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ (২০০১ সালে) এবং বারাক ওবামা (২০০৮ সালে)—উভয়েই চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিযোগী বলেছিলেন। কিন্তু দুবারই চীন পরিস্থিতিকে নিজের দিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। প্রথমবার টুইন টাওয়ার হামলার পর সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করে এবং দ্বিতীয়বার বৈশ্বিক মহামন্দায় বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজে সহায়তা করে। ইউরোজোন ঋণসংকটে পড়ার পর গ্রিস, পর্তুগাল ও স্পেনের বন্ড কিনে ইউরোপের সঙ্গে নিজের সম্পর্ককে দৃঢ় করেছিল চীন।

এখন করোনা পরিস্থিতিতে চীন আবার বিশ্বের সহায়তায় এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে তার সহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পিপিই, ভেন্টিলেটর, ফেস মাস্ক এবং হাসপাতালের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে তারা। করোনা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে তাকে অনেক সুযোগ করে দিয়েছে।

এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে চীনের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা এবং বিশেষ করে ওষুধসহ সব ধরনের মেডিকেল দ্রব্য রপ্তানি অব্যাহত রাখা দরকার। বহু দেশ এই সংকটে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হবে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকেও তাদের ঋণ পাওয়ার অবস্থা নেই। এর আগে পর্তুগাল, আর্জেন্টিনা ও মিসরের মতো দেশকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে চীন।

সর্বোপরি কোভিড-১৯–এর কল্যাণে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের চিকিৎসকেরা একযোগে কাজ করছেন। দুই দেশের মেডিকেল কোম্পানিগুলো একসঙ্গে কাজ করায় বৈরী পরিবেশ সরে যেতে শুরু করেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব নেতৃত্ব অর্জনে চীন বহু দূর এগিয়ে যাবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
কেইয়্যু জিন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here